রেকর্ডস

আজকাল ইন্টারনেটের সুবাদে গান শোনা অনেক সহজলভ্য হয়ে গেছে, তা সে বাংলা, ইংরেজী, হিন্দি যে গানই হোক না কেন। অথচ একসময় কি কষ্ট করেই না ইংরেজি গান সংগ্রহ করতাম। তখন ছিল লং প্লে বা এলপির যুগ। সিডি যদিও কিছুদিন পরেই এসেছে কিন্তু প্রথমদিকে সিডি/সিডি প্লেয়ার এসবের দামও ছিল আকাশ ছোঁয়া। আমাদের মত গরীবস্য মানুষেরা যাদের এলপি/সিডি কোনটাই পোষার সামর্থ্য ছিল না, তখন এলপি/সিডি থেকে অডিও ক্যাসেটে গান সংগ্রহ করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতাম।

আমার ঘাড়ে ইংরেজী গানের ভূত চাপাটা ছিল একটু অস্বাভাবিক। আব্বা চট্টগ্রাম বেতারে একসময় নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। আর সব রবীন্দ্রপ্রেমীর মত তাঁরও ছিল রবীন্দ্রসংগীতের বিশাল কালেকশন। ওনার কাছ থেকেই দেখেছি কি যত্ন করে উনি রেকর্ডিং করতেন। বাজারে যে সব রবীন্দ্রসংগীতের এলবাম পাওয়া যেত সেগুলোতে নিম্নমানের ক্যাসেট ব্যবহার করা হত বলে কখনো কিনতেন না; সবসময় নামকরা রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে ভাল মানের ক্যাসেটে গান সংগ্রহ করতেন। বাসায় এমন রাবীন্দ্রিক আবহ, তাও এহেন আলেম-এর ঘরে আমি জালেম হয়ে গেলাম। রবীন্দ্র সংগীতের পথে আর পা মাড়ালাম না।

আমার প্রথম শোনা ইংরেজী গান সুইডিশ পপ গ্রুপ ‘এবা’-র একটা মিক্সড এলবাম। এটাও আব্বার রেকর্ডিং করা। ওই একটা ইংরেজী ক্যাসেট-ই বাসায় ছিল তখন। কি মনে করে যে তিনি এটা রেকর্ডিং করেছিলেন, তা জানি না। অবশ্য ‘এবা’, ‘বনি এম’- এই টাইপের ব্যান্ডগুলো তখন বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিটিভি-তে ‘সলিড গোল্ড’ নামের একটা ইংরেজী গানের অনুষ্ঠানে এসব ব্যান্ডের গান মাঝে মাঝে দেখতাম। যদিও ‘বনি এম’-এর ওই বানর সদৃশ লোকটার লম্ফ-ঝম্প দেখতে খুবই বিরক্ত লাগত।

ইংরেজী গান আমার প্রথম ভাল লাগা শুরু হল মনে হয় ক্লাস সেভেনে। এক বন্ধুর হাত ঘুরে তার মামার রেকর্ডিং করা একটা ক্যাসেট এল আমার কাছে। অনেক নতুন নতুন শিল্পী আর ব্যান্ডের গান শুনলাম তখন- রিচার্ড মার্ক্স, এলান পারসন্স প্রজেক্ট, কুল এন্ড দ্য গ্যাং, ফরেনার ইত্যাদি। এতদিন যে সব ইংরেজি গান শুনতাম বা বিটিভিতে দেখতাম তার চাইতে এগুলো ছিল একদম অন্যরকম। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর মামা এটা কোথেকে রেকর্ডিং করেছে? সে খোঁজ করে জানাল- ‘রেকর্ডস’। সেই থেকে আমার রেকর্ডসে আনাগোনা শুরু হল।

তখন চট্টগ্রামে ওই একটাই ইংরেজী গানের রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল। চট্টগ্রাম মেডিকেল ফেলে সামনে যেতে আলমাস সিনেমা হলের কাছাকাছি মেহেদিবাগ এলাকায় দোকানটা ছিল (মনে হয় এখনো আছে)। ড্রাগ এডিক্টদের মত আমারও নেশা হয়ে গেল ‘রেকর্ডস’-এ যাওয়া আর গান রেকর্ডিং করা। কিন্তু বাধ সাধল টাকা। একটা ৬০ মিনিটের ক্যাসেট রেকর্ডিং করতে ৯০ টাকা লাগে, আর ৯০ মিনিটের জন্য ১২০ টাকা। এত টাকা কোথায় পাব? বাসায় যদি বলি ইংরেজী গান রেকর্ডিং করব, টাকা দাও; ভাববে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বখে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছি। বুদ্ধি একটা পেয়ে গেলাম। তখন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। বাসা থেকে অনেক দূর, দশ টাকা রিক্সা ভাড়া লাগে, আসা-যাওয়া বিশ টাকা। সে সময় দশ টাকা দিয়ে পুরো চিটাগাং শহর ঘুরে আসা যেত। ঠিক করলাম, বাসা থেকে রিক্সার টাকা নিয়ে বাস বা টেম্পোতে যাতায়াত করব। অনেক টাকা বাঁচানো যাবে। শখের জন্য না হয় একটু ত্যাগই স্বীকার করলাম!

টেম্পোর কথা প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন সকালে স্যারের কাছে ব্যাচে পড়ি। ব্যাচে গার্লস স্কুলের মেয়েরাও একসাথে পড়ত। স্যারের কাছে পড়ার চেয়ে আমাদের ওই আকর্ষণই বেশী। একতরফা প্রেমে পড়ে মাঝে মাঝে কার কি করূণ দশা হচ্ছে এটা নিয়েও আমরা মজা করতাম। একদিন এক বন্ধু তার টেম্পোতে চড়ার করুণ কাহিনী বর্ণণা করল। ব্যাচেরই এক মেয়েকে সে পছন্দ করত মনে মনে। একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় টেম্পোর ভিতরে জায়গা না পেয়ে সে বাইরে হেলপার-এর সাথে ঝুলে ঝুলে আসছিল। হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেল পেছনের যে দামী গাড়ীটা এতক্ষণ টেম্পোর পেছন পেছন আসছিল, তাতে তার পছন্দের মেয়ে বসে আছে। সারাদিন সে খুবই মন খারাপ করে রইল। আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মত এরপর থেকে আমরা এটা নিয়ে তার সাথে মজা করতে লাগলাম!

রেকর্ডসের কথায় ফিরে আসি। বিশ টাকা থেকে একটু একটু করে ক্যাসেট রেকর্ডিং-এর জন্য সেইভ করতে আমার মোটামুটি অনেক দিন লাগত। যখনই টাকাটা জমত দিতাম দৌড়। কিন্ত রেকর্ডসের সিরিয়াল এত লম্বা থাকত, আমার ক্যাসেট হাতে পেতে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হত। প্রায়ই দেখা যেত, অর্ডার দেয়ার পর কাকুতি-মিনতি করছি, ভাইয়া আমার ডেট-টা একটু আগে দেন, আমি তো সবসময় আসি। মাঝে মাঝে দয়া-পরবশ হয়ে সিরিয়াল আগে করে দিত আর আমি বিশ্বজয়ের ভাব নিয়ে ফিরতাম। তখন গান-বাছাই করাটা ছিল এক বিরাট প্রব্লেম। এখন যেমন নতুন গান শুনে তারপর রেকর্ডিং করতে দেয়া যায়, তখন তো এমন ছিল না। মাঝে মাঝে বিচিত্রা বা ম্যাগাজিনগুলাতে বিলবোর্ড/ইউ কে/ইউএস টপ চার্ট দিত। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিন উল্টিয়ে গানের টাইটেলগুলো মুখস্থ করে আসতাম আর অন্ধের মত সেগুলোই দিতাম। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যাদের গান পছন্দ করি, তাদের কেউ যদি চার্টে আসত তখন শুধু দিতাম। গানের লিরিক যোগাড় করা ছিল আরেক ঝক্কি। বাংলা গানই লিরিক ছাড়া বোঝা যায় না, তায় আবার ইংরেজী গান। মাঝে মাঝে ইংরেজী লিরিকের ম্যগাজিন বের হত। বইয়ের দোকানে, ফুটপাতে খুঁজে ওগুলোই কিনতাম। এলপি/সিডি-র সাথে অনেক সময় গানের লিরিক দেয়া থাকত। রেকর্ডসে দিয়ে কান্নাকাটি করতাম, ভাইয়া লিরিকসের কাভারটা একটু দেন, ফটোকপি করে দিয়ে যাচ্ছি। তা চিটাগাং-এ যেহেতু একটাই দোকান ছিল, রেকর্ডস-এর লোকগুলা সে জন্যেই মনে হয় হেভী মুডে থাকত। ইচ্ছা হলে দিত, না হলে দিত না। আজ যখন গুগলে টিপ দিলেই লিরিক চলে আসে, তখন আমার সেই কান্না-কাটির দিনগুলোর কথা মনে হলে হাসিই পায়।

রেকর্ডস নিয়ে একটা দুঃখের স্মৃতিও আছে। রেকর্ডসে প্রায়ই একটা ফর্সামত ছেলেকে দেখতাম একমনে রেকর্ডিং করছে বা ক্যাসেটের কাভারে গানের টাইটেল গুলো লিখছে। মুক্তোর মত তার হাতের লেখা। আমার রেকর্ডিং করা অনেকগুলো ক্যাসেটেই তার হাতের লেখা আছে। চট্টগ্রাম কলেজে ক্লাস শুরু করার পর একদিন দেখি সে আমার পাশেই বসে আছে। ‘আরে, তুমি রেকর্ডস-এর না!’ সেও গলায় খুবই ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি যাই ওখানে মাঝে মাঝে, ওখানকার ম্যাক্সিমাম টাইটেল আমার লেখা’। পরে তার কাছে জানলাম সে আসলে রেকর্ডসের মালিকদের কেউ না, একসময় সে ওখানে আমার মতই পয়সা দিয়ে গান রেকর্ডিং করতে যেত। তার হাতের লেখা দেখে ওরা তাকে টাইটেল গুলা লিখে দিতে বলেছে, বিনিময়ে ইচ্ছেমতো রেকর্ডিং ফ্রি! ছেলেটার নাম শ্রীকান্ত। শ্রীকান্ত রক্ষিত। আমেরিকায় আসার পর একদিন বিস্মিত হয়ে পত্রিকার ফ্রন্ট পেইজে আমি শ্রীকান্তের ছবি দেখলাম। আরে শ্রীকান্ত, এক্কেবারে ফ্রন্ট পেইজে! প্রথম বিস্ময়ের ধাক্কা কাটতে না কাটতেই হতভম্ব হয়ে হেডিং পড়লাম- ‘সন্ত্রাসীদের হাতে শ্রীকান্ত রক্ষিত নিহত’। শ্রীকান্তের বাবা মারা গিয়েছিল আগেই। জমি-জমা নিয়ে বোধহয় কিছু বিরোধ চলছিল, তার জের ধরেই এই খুন। এমন একটা গান-পাগল ছেলে যে শুধু গান শোনার লোভেই রেকর্ডিং স্টুডিওতে স্বেচ্ছাশ্রম দিত, তাকেও মানুষ খুন করে ফেলতে পারে- এটা কিভাবে সম্ভব হয়, আমি বুঝতে পারি না!

একসময় আমার রেকর্ডিং করা ক্যাসেটের সংগ্রহকেই মনে হত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ! কত মায়া-মমতা, কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ক্ষুদ্র এক একটা ক্যাসেটের পেছনে। এখানে আসার সময় সবার হাসি-ঠাট্টা উপেক্ষা করে অল্প কিছু ক্যাসেটও নিয়ে এসেছিলাম। এখন তো সিডি-ও শোনা হয় না। যা কিছু সব ইন্টারনেটেই শুনি। মাঝে মাঝে ক্যাসেটগুলোর ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করি, শ্রীকান্তের হাতে লেখা টাইটেলগুলো নেড়েচেড়ে দেখি; আর স্মৃতির কোন এক অতল গহবর থেকে ফিরে ফিরে আসে আমার কৈশোর, আমার স্বর্ণালী দিনগুলো।
Those were such happy times
And not so long ago
How I wondered where they’d gone
But they’re back again
Just like a long lost friend
All the songs I loved so well.

© তানভীর ইসলাম | ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট

About তানভীর

সহকারী অধ্যাপক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জ্যাকসনভিল স্টেট ইউনিভার্সিটি, অ্যালাবামা। অনুমতি ছাড়া লেখাগুলো যে কোনো মাধ্যমে পুনর্মুদ্রণ নিষেধ। ইমেইল- tanveer9515 এট ইয়াহু ডট কম

Posted on মার্চ 16, 2012, in স্মৃতিচারণ. Bookmark the permalink. এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান